Cover img
image

টাটা আলট্রা ম্যারাথন ২০২২। এই প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উড়লো ভারতের মহারাষ্ট্রের পাহাড়ি লোনাভালায়।

ইচ্ছে ছিল ২০২০ সালে আল্ট্রা ওয়ারিয়র নৈনিতাল ট্রেইল আলট্রা ম্যারাথন যাওয়ার। কিন্তু টানা দুই বছর কোভিডের কারনে সব বন্ধ। ২০২২ এ সব উন্মুক্ত হওয়ায় নৈনিতালের প্রস্তুতি নেয়ার সময় আমাদের রানিং কমিউনিটির শ্রদ্ধেয় নৃপেন চৌধুরী দা টাটা আলট্রা ম্যারথনের পোস্ট দিলেন। উল্লেখ্য “টাটা আলট্রা ম্যারাথন " এক মাত্র আন্তর্জাতিক আলট্রা ম্যারাথন যা AFI, AIMS ও IAU সনদ প্রাপ্ত। আমার রানিং পরামর্শক, সহযাত্রী শাহজাদা আব্দুল আউয়াল শাহ বললো, নৈনিতাল বাদ, চলেন টাটা আলট্রা দিয়ে আসি।

টাটা আলট্রার ওয়েবসাইটে ৫০ কিলোমিটারের এলিভেশন চার্ট দেখে চোখ ছানাবড়া। কোনদিন পাহাড় চড়ি নাই। সেখানে ৫০ কিলোমিটারের আল্ট্রা! কিভাবে সম্ভব? যেহেতু এর আগে তিনবার আলট্রা দেয়ার অভিজ্ঞতা আছে, তাই সরাসরি “না” বলতে পারি নাই। আর শাহজাদা তো স্পেশিয়ালিস্ট আল্ট্রা রানার। গত ডিসেম্বরে তপ্ত রোদের মধ্যে কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভ আল্ট্রা ম্যারাথনে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছে, অর্থাৎ ১০০ কিলোমিটার পার করেছে।

দিনের পর দিন শাহজাদার তাগিদে ইভেন্ট রেজিস্ট্রেশন, ভিসা, এয়ার টিকেট করে ১৩ মে সকালে মুম্বাইর উদ্দেশ্যে শাহজালাল আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টে। এয়ারপোর্টে আসার আগে মেয়ে একটি পতাকা হাতে দিয়ে বললো, ফিনিশ লাইনে পৌঁছে একটা ছবি পাঠিয়ে দিও। শাহজাদার হাতেও একটা স্ট্যান্ডার্ড সাইজের পতাকা এবং মেয়ের হাতে বানানো বাজারের ম্যাসকাপড়ের ব্যাগ কেটে বানানো ছোট্ট একটা পতাকা। এর মূল্য অসীম। মনে হচ্ছিল, স্বশরীরে দু’জন গেলেও সাথে নিয়ে যাচ্ছি বাংলাদেশ। লক্ষ্য একটাই, ভারতের মহারাষ্ট্রের লোনাভালার পাহাড়ে অনুস্ঠিত টাটা আল্ট্রা ম্যারাথনে বাংলাদেশেকে রিপ্রেজেন্ট করা এবং প্রথমবারের মত এই ইভেন্টে বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো।

ঢাকা থেকে কলকাতা হয়ে মুম্বাই এয়ারপোর্ট পৌঁছে বাস ধরে প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরত্বের লোনাভালার হোটেলে পৌঁছতে রাত আড়াইটা। ইভেন্টের আগের রাত একটা ভালো ঘুম দরকার। তা আর হলো না। শাহজাদা এবং আমার ফ্রেশ হয়ে শুতে রাত সারে তিনটা। ঘুমানোর সময় পার হয় গেছে। আর কি ঘুম হয়? এদিকে সকাল ১১ টায় টাটা আলট্রার বাসে করে পুরো ৫০ কিলোমিটার রেইস রুট দেখতে যেতে হবে। ঘড়িতে সকাল ৯ টার এলার্ম দিয়ে শুয়ে পরলাম।

১৪ মে। সকাল দশটায় রেডি হয়ে দু’জন হোটেল থেকে বের হয় Sunils Wax Museum এ পৌঁছলাম। এটাই রেইসের স্টার্টিং পয়েন্ট। এখান থেকেই বাস ছাড়বে। শহর থেকে ২/৩ কিলোমিটার পার করে পুরো পাহাড়ি রাস্তায় ঢুকে পরলাম। অনেক আপ-হিল, ডাউন-হিল পার করে শেষ পর্যন্ত ফিনিশ পয়েন্টে এসে গাড়ি থামলো। রোড রেইস হলেও মাঝে বেশ অনেকটা রাস্তা পাথরের খানা-খন্দে ভড়া। পাহাড়ি উঁচু - নিচুতে চলার সময় বাসের ইন্জিনের আওয়াজ দিচ্ছিল, রেইস কতটা কস্টরকর হবে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সাথে রানিং এ্যাপ চালু থাকায় এ্যাপের ডাটা অনুযায়ী অনেকগুলো আপ-হিল থাকায় সব মিলিয়ে প্রায় ১২ কিলোমিটার ক্লাইবিং, এলিভেশন গেইন ৯২৫ মিটার, এলিভেশন লস হবে ৮২০ মিটার এবং সর্বোচ্চ উচ্চতা ৮২১ মিটার, সর্বনিম্ন উচ্চতা ৬০৩ মিটার হবে। টাটা আল্ট্রা ম্যারথনের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে একটা এলিভেশন চার্ট ছাড়া তেমন কোন তথ্য না থাকায় রুট পরিদর্শনের পর বেশ খানিকটা ধাক্কা খেলাম। আল্ট্রা স্পেশিয়ালিস্ট শাহজাদাও কিছুটা ধাক্কা খেয়েছে। মুখে কিছু বলছে না, কিন্তু কিছুটা চিন্তিত মনে হচ্ছে। ও বললো, “টাটা আল্ট্রা ম্যারাথন নামটাও বিভ্রান্তির। কারন, নামটা দেখে ধরে নিয়েছিলাম সিম্পল রোড আল্ট্রা, সাথে কিছু এলিভেশন থাকবে।”

হোটেলে ফিরে শাহজাদাকে বললাম, ভাই আপনি যান, আমার দ্বারা এই কর্ম হবে না। আমার যাওয়া মানে জেনেশুনে বিষ পান করা। সুস্থ্য মস্তিস্কে বিষপান করা ঠিক না।

কঠিন কোন কাজ শুরুর আগে আমি ধরেই নেই এটার যোগ্য হয়তো নই, কিন্তু চেস্টা করতে তো দোষের কিছু নেই। চেস্টার শেষে যদি সফলতার ছিটেফোঁটাও জোটে সেটাই বোনাস। না জুটলোও ক্ষতি নেই। আর এই পাওয়া বোনাসটুকুর আনন্দ অসীম।

মনকে এই সান্ত্বনা দিয়েই রাত সারে এগারটায় হোটেল থেকে বের হলাম। দূরত্ব সারে তিন কিলো। হাঁটা ছাড়া উপায় নেই। দু’জন হাঁটা শুরু করলাম লাইট হাতে। দেড় কিলোমিটার যাওয়ার পর পিছন থেকে একটা গাড়ির হর্ন শুনে ফিরে তাকালাম। বললেন, গাড়িতে উঠুন। উনিও একজন পার্টিসিপেন্ট। গোয়া থেকে এসেছেন। নাম সুনিল যাদব। প্রাণবন্ত, হাসিখুশি মানুষ। বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে তিনি খুব অবাক।

যাই হোক রেইস শুরুর আগে রানারদের দেখে শাহজাদাকে বললাম, এখানে সব দেখি রানার, আমার মত একজনও শখ করে আসে নাই। এদের শারিরিক গঠন দেখেছেন? আমি তো শেষ করতে পারবোই না, করলেও আমার পিছনে একজনও অবশিস্ট থাকবে না। এদিকে স্টার্টিং পয়েন্ট থেকে মাইকে বার বার ঘোষনা দিচ্ছে, “নো কাট-অফ-টাইম, রেইসজুড়ে অনেক আপ-হিল, ডাউন-হিল, সাথে প্রচন্ড হিউমিডিটি, সুতরাং আপনারা কেউ তাড়াহুড়ো করবেন না, সুস্থভাবে সবাই ফিনিশ করুন”। ঘোষনা শুনে মনে হলো, এক সমুদ্র জল ঢেলে দিয়ে অস্থির মনটাকে ঠান্ডা করে দিয়ে গেল।

নির্ধারিত সময়ের ১ ঘন্টা পর ১৫ মে রাত ১ঃ০০ টায় রেইস শুরু হলো। প্রথম কয়েক কিলোমিটার রাস্তা বেশ ভালোই ছিল। অতটা উচ্চতা ছিল না বললেই চলে। অনেকটা আমাদের হাতিরঝিলের ব্রীজের উচ্চতার মত হবে। শাহজাদা বেশ গ্রামার মেনে দৌড় শুরু করলেও আমি গ্রামারের ধারে কাছেও নেই। তাই সে পরিমিত স্পীডে শুরু করলেও আমার স্পীড আমার তুলনায় একটু বেশিই ছিল। ১ কিলোমিটারের দিকে শাহজাদা আমাকে টপকে আগে চলে যায়। আমি আমার মত ধীর গতিতে। ৬ কিলোমিটার পার করে যখন ঘেমে জবজবা, তখন বামদিকের একটা সাইনবোর্ড চোখে পরলো, “২.৫ কিলো আপ-হিল”। আসল রেইস এখান থেকেই শুরু।

আজ পূর্ণিমাদেবীর মিস্টি আলোয় দৌড়ানোর কথা থাকলেও দুস্ট মেঘবালকেরা তাকে কালো চাদরে ঢেকে রাখায় একমাত্র হেড লাইটই ভরসা। তখন রাত দেড়টা। হঠাৎ ডান পাশে তাকাতেই সাদা ধোঁয়ার মত। ভাবলাম, কেউ হয়তো খড়কুটোয় আগুন দিয়েছে। এরপর কিছুটা এগুতেই চলার পথেই একদম পায়ের সামনে সেই সাদা ধোঁয়া ভেসে বেড়াচ্ছে। কিন্তু এ কেমন ধোঁয়া, যার কোন গন্ধ নেই। ধোঁয়ায় শ্বাস রোধ করে, তাও হচ্ছে না। এতক্ষনে বুঝলাম এগুলো মেঘ।

অন্ধকার। সামনে-পিছনে কেউ নেই। এবার একদল মেঘবালিকা এসে সাদা চাদরে ঘামে ভেজা ক্লান্ত শরীরটাকে জড়িয়ে ঠান্ডা আবেশ বুলিয়ে গেল… একটু ধাক্কাও খেলাম মনে হয়। মেঘবালিকাদের ভীড়ে চারপাশের কিছুই দেখা যায় না। যতই সামনে এগুচ্ছি, ততটাই জড়িয়ে ধরছে। ওরা হয়তো মনে মনে বলছে, যেতে নাহি দিব…. কিন্তু তাদের এই ভালোবাসা, আলিঙ্গন উপেক্ষা করা ছাড়া কোন উপায় নেই।

প্রথম দীর্ঘ ২.৫ কিলোমিটারের আপ-হিল কমপ্লিট করার পর নিজের আত্মবিশ্বাস বেড়ে যাওয়ায় মোটামুটি কনফার্ম, এই রেইস শেষ করতে পারবো। ততক্ষনে আপ-হিল, ডাউন-হিল গুলো বেশ এনজয় করতে লাগলাম। কস্টকর কাজগুলো আনন্দের সাথে করতে হয়। তাহলে কস্টগুলো কস্ট লাগে না।

ভোররাত চারটার দিকে আমার যখন ২১ কিলো তখন শাহজাদা অলরেডী ২৩ কিলোর ইউটার্ন পার করে ২৫ কিলোতে। আমার থেকে ৪ কিলোমিটার এগিয়ে আছে। ইউটার্নের পর রাস্তাঘাট পরিচিত হওয়ায় ফিরতে বেশ ভালোই লাগছিল। কিন্তু ৩১ কিলোর পর ডানদিকের নতুন রাস্তা। এরপর টানা ৪ কিলোমিটার পাথর কুঁচির রাস্তা। ত্রিভুজ আকারে কালো পাথরগুলো বিদ্রুপের দৃস্টিতে তাকিয়ে বলছে - এতক্ষন তো দৌড়াালি, পারলে এখন দৌড়া? এই রাস্তাটুকু বেশ ভুগিয়েছে।

রাতের অন্ধকার কেটে ভোরের আলো। সকাল সারে ছয়টা। ততক্ষনে ৩৫ কিলো শেষ। নিজের পারফরমেন্সে নিজেই মুগ্ধ! মুগ্ধ হওয়া ছাড়া উপায়ও নেই। ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত নিজের প্রতি মুগ্ধ থাকতে হবে, নিজেকে নিজে ধন্যবাদ দিতে হবে। নয়তো এই দুর্গম গিরি কান্তার-মরু দুস্তর পারাবার হবে না। শাহজাদা ততক্ষনে নিশ্চয়ই ৪০/৪২ কিলো কমপ্লিট করে ফেলেছে। ৪০ কিলোর পর গুনে গুনে ৬ জনকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গেলাম। কি শান্তি! আমি ও পারি।

এদিকে বেলা যতটা বাড়ছে, সূর্যের তেজে টেকা ততটাই কস্টকর হচ্ছে। শাহজাদা নিশ্চয়ই এতক্ষনে দেশের পতাকা উড়িয়ে গলায় মেডেল পরে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। ৪৫ কিলোতে এসে একটু ডাউন পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়েও স্বস্তি পেলাম না। একদম খাঁড়া ডাউন। স্পীড বাড়ানোর উপায় নেই। শরীরটাকে পিছনে হেলিয়ে পায়ের উপর চাপ দিয়ে দিয়ে সাবধানে নামতে হচ্ছে। তাও ভালো উপরে উঠতে হচ্ছে না। ভাবলাম, আপ-হিল মনে হয় শেষ। কিন্তু সুখ বেশিক্ষন সইলো না। ৪৮ কিলোতে এসে আবার আপ-হিল। শেষ দুই কিলোমিটার একটু শান্তিতে পার করবো, তার উপায় নেই।

শেষ দুই কিলোমিটার ছিল সবচে বাজে আপ-হিল। ততক্ষনে শরীরে এনার্জি শেষ। পা টিপে টিপে কচ্ছপের গতিতে একটু একটু করে উপরে আগাচ্ছি। পা একটু ফস্কে গেলে আর দেখতে হবে না। মনে হচ্ছিল ৬০ ডিগ্রি এঙ্গেলে উঠছি।

ওদিকে শাহজাদা বলেছিল, লাস্ট কিলোতে মেসেজ দিয়ে জানাতে। ফিনিশিং সময়টুকু ভিডিওতে ধরে রাখার জন্য। মেসেজ পাঠিয়ে পতাকা তুলে এগুচ্ছি। ঘড়িতে সকাল সারে নয়টা। দেশের পতাকা উড়িয়ে শেষ পর্যন্ত ফিনিশ লাইনের ফিতা ছুঁয়ে গলায় মেডেল। যা ছিল অপ্রত্যাশিত। "টাটা আলট্রা ম্যারাথন " এক মাত্র আন্তর্জাতিক আলট্রা ম্যারাথন যাহা AFI, AIMS ও IAU সনদ প্রাপ্ত। আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না, আমার অলস শরীর এমন কঠিন একটি আলট্রার রুট পেরিয়ে ফিনিশ লাইন পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। এবং সবচে আনন্দের এই প্রথম বাংলাদেশী পরিচয়ে আমরা দু’জন এই ইভেন্ট শেষ করলাম। টাটা আলট্রা ম্যারথনের এই দূর্গম ৫০ কিলোমিটার শেষ করতে শাহজাদা আউয়াল শাহ এর সময় লেগেছে ৭ ঘন্টা ৪৩ মিনিট। এবং আমার ৮ ঘন্টা ৩০ মিনিট।

আমাদের হাতে বাংলাদেশের পতাকা দেখে ফিনিশ লাইনের লোকজন মুহুর্মূহু হাততালিতে ভড়িয়ে দিল। তাদের চোখে বিস্ময়, বাংলাদেশ থেকে এসে টাটা আলট্রা ম্যারথনের মত একটা আলট্রা ফিনিশ করার জন্য। কাছে এসে শাহজাদাকে জিজ্ঞেস করলো, আপনারা কি শুধু আলট্রা দেয়ার জন্যই এসেছেন নাকি ঘোরাঘুরির সাথে আলট্রা দিলেন। শুধুমাত্র আলট্রা দেয়ার জন্য এতদূর এসেছি শুনে তো কয়েকজনের বিস্ময় তো কাটছিলই না। সবকিছুর জন্য সহযাত্রী শাহজাদার প্রতি কৃতজ্ঞ।